বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
বিলোনীয়া স্থলবন্দরে শুল্ক ছাড়াই চলছে আমদানি ও রপ্তানি
বিলোনীয়া স্থলবন্দরে শুল্ক ছাড়াই চলছে আমদানি ও রপ্তানি

বিলোনীয়া স্থলবন্দরে শুল্ক ছাড়াই চলছে আমদানি ও রপ্তানি

ফেনী প্রতিনিধি
প্রকাশের সময় : October 04, 2023 | রফতানি

দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য আমদানি এবং রপ্তানি করছে ফেনীর পরশুরামের বিলোনীয়া স্থলবন্দর দিয়ে। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে এই পাচার কার্য  চালিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এই বন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি করার কাজে ১৬০ টি ক্লিয়ারিং এবং ফরোয়াডিং এজেন্সির নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু কাজ করছে মাত্র ৪ টি  এজেন্সি। ওই প্রতিষ্ঠান গুলো হলো যথাক্রমে জাওয়াদ এন্টারপ্রাইজ, স্ট্যানডার্ড শিপিং, উত্তরণ টেডার্স এবং জিয়ান এন্টারপ্রাইজ।

জানা গেছে , কর্মরত এজেন্সিগুলো পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করে  অথবা কখনো করেনি রপ্তানিও। কিন্তু রপ্তানি কাগজপত্র বলছে পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রাও এসেছে। জালিয়াতি করে তৈরি করা সেই কাগজপত্র দিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার প্রণোদনা। রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্য দেখিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে, তাতে প্রণোদনা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা কম মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে। এতে একদিকে দেশে রপ্তানির অর্থ পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে। আবার পণ্যে কম বা বেশি দেখিয়ে রপ্তানি হচ্ছে। এতেও অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার পণ্যের স্যাম্পল বা নমুনা ঘোষণায় কনটেইনার ভর্তি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। নমুনার আড়ালে কনটেইনার ভর্তি পণ্য রপ্তানির টাকাও পাচার হচ্ছে। রপ্তানিতে প্রতিনিয়ত ম্যাজিক কৌশলে কোটি কোটি টাকা অর্থ পাচার যেমন হচ্ছে, তেমনি সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টম হাউস ও স্টেশনে রপ্তানি পণ্য সঠিকভাবে শুল্কায়ন হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্য কায়িক পরীক্ষা হয় না। অ্যাসাইকুডায় পণ্য শুল্কায়ন হয় না। শুধু কর্মকর্তারা রপ্তানির কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দেন। ফলে রপ্তানিতে জালিয়াত চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রপ্তানি পণ্য শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। অথচ জালিয়াতিতে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে অর্থ পাচার ও রাজস্ব ফাঁকি রোধ সম্ভব হবে।

সূত্রমতে,  বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বাণিজ্যে মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচার ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ প্রতিরোধে ছয়টি সুপারিশ দিয়ে এনবিআরকে প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশে অর্থ পাচারের লক্ষ্যে রপ্তানিতে পণ্য মূল্য কম (আন্ডার ইনভয়েসিং) ঘোষণা দেয়া, রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা অবৈধ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্তির লক্ষ্যে রপ্তানিতে পণ্য মূল্য প্রকৃত মূল্য থেকে বেশি দেখানো বর্তমানে বহুল সংঘতি এবং আলোচিত একটি সমস্যা। অসত্য মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানি বা ঘোষণাতিরিক্ত বা ঘোষণা অপেক্ষা কম পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সংঘটিত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ প্রতিহত করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিংয়ের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে রপ্তানিতে কোন কৌশলে অর্থ পাচার হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে এসব জালিয়াতি উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,  ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য চালানের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য ঘোষণা দিয়ে রপ্তানির চলছে এই বন্দর দিয়ে। এর মধ্যে নাম উঠে এসেছে  আমদানী এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান  উত্তরন ট্রেডার্স এবং জিয়ান এন্টারপ্রাইজের। জানা যায় এই দুটি  এজেন্সির মালিক মিজানুর রহমান।

অনুসন্ধানে জানা যায়,  একই  মালিকের এই এজেন্সির বিরুদ্ধে পণ্য চালানে প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা কম ঘোষণা, প্রকৃত রপ্তানি মূল্য গোপন করে রপ্তানির  জালিয়াতির ঘটনা রয়েছে।

এই এজেন্সির মূল কাজ হলো কম পরিমাণ পণ্য ঘোষণায় অধিক পরিমাণ পণ্য রপ্তানি, অধিক পরিমাণ ঘোষণায় কম পণ্য রপ্তানি।
অনুসন্ধানে জানা যায় ,  এই এজেন্সিগুলো  বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি অর্থাৎ অন্য প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করে আসছে। আবার বিল অব এক্সপোর্টে স্যাম্পল বা নমুনা রপ্তানির কথা উল্লেখ করেছে। এভাবে এই এজেন্সিগুলো কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে।

আরো দেখুন: যে কারণে কমছে রেমিট্যান্সের গতি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দর সংশ্লিষ্ট এক কর্মচারী এক জিজ্ঞাসার জবাবে  বলেন,  যেমন কোন  পণ্য রপ্তানি হয়নি। কিন্তু কিছু আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক এজেন্ট জাল বা ভুয়া রপ্তানির কাগজপত্র তৈরি করেছে। যা দেখিয়ে প্রণোদনা আত্মসাৎ করেছে।  অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,কাস্টমস গোয়েন্দারা এই বিষয়ে জানে কিনা তার জানা নেই। তিনি আরো বলেন, দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির পণ্য কখনও  বন্দরে প্রবেশ করেনি। এমনকি কোনো পণ্য রপ্তানিও হয়নি। কিন্তু রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র (বিল অব এক্সপোর্ট, এলসি, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট) তৈরি করেছে। যার বিপরীতে ভারত থেকে রপ্তানির টাকা এসেছে দাবি করে প্রণোদনা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। এমন বহু প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রণোদনা আত্মসাৎ করেছে বলেও তিনি জানান। দীর্ঘ দিন ধরে এমন অনৈতিক কাজ চলছে  শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে কিন্তু  কতৃপক্ষ কেন যে নীরব রয়েছে তার বোধগম্য নয় বলে ও ক্ষোভের সাথে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের  ওই কর্মচারী।

সূত্রমতে, রপ্তানিতে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার রোধে ছয়টি পদক্ষেপ নিতে প্রতিবেদনে এনবিআরকে সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হলো, ঝুঁকিপূর্ণ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে  সেগুলোর রপ্তানি পণ্যের মূল্য ও পরিমাণের সঠিকতা নিশ্চিত করে রপ্তানির অনুমোদন দেয়া। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কাস্টম হাউস ও স্টেশনকে নির্দেশনা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, এনবিআর, অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও কাস্টম কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমে অনিয়ম প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করা। তৃতীয়ত, রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য, মজুরি, কারখানার ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা। চতুর্থত, যেকোনো পণ্যের রপ্তানি পারমিট ইস্যুর আগে পণ্যের বিবরণ ও পরিমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করেছে কি না তা ব্যাংক কর্মকর্তা রপ্তানি পারমিট ইস্যুকারী কর্মকর্তার যাচাই করা। পঞ্চমত, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। ষষ্ঠত, অনিয়ম করা রপ্তানি পণ্য চালানের পরীক্ষণ ও শুল্কায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া।
বিলোনীয়া বন্দরে কর্মরত মাল স্কেলিংয়ের দায়িত্বে থাকা ইমাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, লোকবল কম থাকায় তিনি আপাতত: এই পোস্টে আছেন।  মাল স্কেলিং এরপর ওজন ম্যানুয়্যালি  রেজিস্ট্রারে লিখা হয় এখনো অটোমেশন পদ্ধতি চালু হয়নি।তিনি বলেন সেই রেজিস্টার কাষ্টমস কতৃপক্ষ চেকের মাধ্যমে  মাল রিলিজ দেন। আমদানি এবং রপ্তানিতে যে কারচুপি হচ্ছে এটা তিনি জানেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি তা জানেন না বলে অস্বীকার করেন।

এই বিষয়ে উত্ররণ ট্রেডার্স ও জিয়ান এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমানকে তার মুঠোফোনে বার বার কল দিয়ে ও পাওয়া যায়নি।
অন্য এক বিশ্বস্ত সুত্রে জানা যায়,  কাষ্টমস ও শুল্ক অফিসে কর্মরত কর্মচারী সাদ্দাম  এই অপকর্মের  অন্যতম সহায়ক। এই বিষয়ে সাদ্দামের কাছে জানতে চাইলে সাদ্দাম এই ব্যাপারে জানেননা বলে জানান।তিনি বলেন ,আমি এখানে সাধারণ কর্মচারী আমার কথায়তো বন্দর চলেনা। উত্তরনট্রের্ডাস  এবং জিয়ান এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান ফোন রিসিভ করেননা  কেন সাদ্দামের কাছে জানতে চাইলে,বলেন মিজানুর রহমান খুব ব্যস্ত লোক।

বিলোনীয়া স্থলবন্দর কাষ্টমস ও শুল্ক কর্মকর্তা রেহানা পারভিনের নিকট এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমি  বিলোনীয়া স্হলবন্দরে যোগদান করেছি গত সপ্তাহে। এখনো আমি কাউকে এবং কয়টা আমদানি_ রফতানিকারক এজেন্সি কাজ করছে  এবং এগুলোর স্বত্ত্বাধিকারী কারা আমি কিছূই জানি না। তবে দ্রুত খোঁজ খবর নিবেন বলে জানান।

বিলোনীয়া স্থলবন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ ইব্রাহিম জানান, তিনি অসমর্থিত সূত্রে  এই বিষয়টা জেনেছেন তবে কতটুকু সত্য তিনি তা জানেন না বলে জানান।

উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালের অক্টোবরে ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ  সন্মতিতে এই   বিলোনীয়া বন্দরের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ থেকে সিমেন্ট,ইট এবং পাথর রপ্তানি এবং ভারত থেকে গরু,কাঠ,শুটকী এবং সার্জিক্যাল সরঞ্জাম আমদানির কথা ছিল।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে, সিমেন্ট,পাথর,নাইলনের দড়িসহ ফিসিং নেট ধারাবাহিক ভাবে রপ্তানি হলেও ভারত থেকে কালেভদ্রে আদা, মসলা ও শুটকী ছাড়া তেমন কিছুই  আমদানি হয়না।

সুত্র জানায়, ভারতীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং ওই দেশের এজেন্সি গুলোর অসহযোগিতার কারণে ভারত থেকে পণ্য আমদানিকারকেরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

 

প্রতিষিদ্ধ/এমএ/ফেনী